খণ্ডচিত্র

Jayasmita Sarkar

4/11/20251 min read

বাড়ির ঠাকুমা- ঠাকুরদা বহু সময়ে উচ্চারণ করে থাকে "দেশের বাড়ি" শব্দটি, বলা বাহুল্য যারা দেশভাগের সময়ে ওপার বাংলা থেকে এপারে আসে তাদের মধ্যে এই শব্দ যেনো অনেক ইতিহাস বহন করে। বর্তমান সময়ে রাজনীতি তথা আধুনিক রাজনৈতিক কাঠামো যেভাবে "দেশ" শব্দটির ব্যাখ্যা করে তা হয়ত গ্রামবাংলা বা আরো বৃহত্তর পরিসরে, দক্ষিণ এশিয়ার যে সমস্ত অঞ্চলের উপর দিয়ে ম্যাপের সরু লাল দাগ চলে গেছে, তাদের জন্য মানসিক ও রাজনৈতিক ভাবে একই রূপে প্রযোজ্য নয়। দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক, ভৌগোলিক, সামাজিক অবস্থায় বহু বৈচিত্র্য লক্ষনীয়। কিন্তু বর্তমান রাজনৈতিক কাঠামো বিশেষ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে পাশ্চাত্য জাতি-রাষ্ট্রের ধারণা, যা রাষ্ট্রের একটি ভাষা, একটি পরিচয়, একই রীতিনীতি, একই খাদ্যাভ্যাসের যান্ত্রিক পরিস্থিতি সৃষ্টি করার পক্ষপাতী, বেনেডিক্ট অ্যান্ডারসন যা “Imagined Community” গ্রন্থে বলেছেন, সেই ব্যবস্থা দক্ষিণ এশিয়ার বৈচিত্র্য পূর্ণ দেশে প্রয়োগ করার চেষ্টা আজও। সেই সব মানুষ গুলির ইতিহাসকে অপ্রাসঙ্গিক করে তোলার চেষ্টা ও অস্তিত্বের সঙ্কট দেখা যায়। উপরের ছবিটি তোর্ষার এক অবিচ্ছেদ্য, আঞ্চলিক জীবন যাত্রার অংশ। এদের সবার "দেশ" সম্পর্কে ধারণা ভিন্ন, কারোর কাছে তার গ্রামেরবাড়ি তার "দেশ"। ছিটমহলের মীমাংসার পর সেই মানুষগুলোর সরকারি পরিচয় পত্র পেলেও , তারা তাদের পরিচয়, অস্তিত্বের সন্ধানে আজও। তারা বৃহত্তর জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে গুরুত্ব পূর্ণ না হলেও তাদের বৈচিত্র্য ও ইতিহাসের উপরে রাষ্ট্র তাদের বোঝায় "দেশ" বলতে তোমায় "এক" হতে হবে। কিন্তু ভাবার বিষয় দক্ষিণ এশিয়ার বৈচিত্রময় সমাজে সেই "এক" এর ধারণা কতটা সফল? Unity in Diversity এর তত্ত্ব কতটা যথোপযুক্ত? কারণ সেই ঐক্যে বৈচিত্র্যের স্থান কোথায়, বরং শুধুই "এক" প্রতিষ্ঠা করার তাগিদ।

লেখক হাঁসদা সৌভেন্দ্র শেখর রচিত "দ্য আদিবাসী উইল নট ডান্স" ( বাংলা অনুবাদ, আদিবাসীরা নাচবে না) গল্প গ্রন্থে দেখা যায় সাঁওতাল পরগনা থেকে কাজের খোঁজে কলকাতা যাওয়ার সময় পঞ্চাশ টাকা আর দুটো ঠান্ডা পাউরুটির চপের জন্য একজন পুলিশের সঙ্গে শুতে হয়েছিল তালামাই কিস্কুকে। এই শোষণের গল্প বা ইতিহাস নতুন নয়। পিতৃতান্ত্রিক সমাজ পদপীষ্ট করেছে আদিবাসী জনজাতি মানুষদের এবং বিশেষ করে আদিবাসী মহিলাদের। সেই চিরাচরিত শোষণের সাথে যুক্ত হয়েছিলো ব্রিটিশ উপনিবেশ শক্তি। ভারত সহ গোটা দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা সেই আদিম জনজাতি অত্যাচারিত হয় শতকের পর শতক ধরে। বর্তমান সময়ে যে সেই শোষণ শেষ হয়েছে তা একেবারেই নয়। বিশ্বায়নের থাবা এই আদিবাসী সম্প্রদায়ের সামাজিক রীতিনীতি এর উপর দীর্ঘ ছাপ রেখেছে। তাদের অন্যতম স্থান নির্ভরশীলতা- জঙ্গল প্রাকৃতিক সম্পদের উপর তাদের অধিকার আজ খর্ব হয়েছে। পুঁজিবাদী আগ্রাসন তাদের অধিকারকে বেআইনি বলে ঘোষণা করেছে। তাদের সামাজিক রীতিনীতি, প্রচলিত খাদ্যাভ্যাস এসবের ওপর পাশ্চাত্য সভ্যতার আগ্রাসন ঘটেছে। এবং এই বিশ্বায়ন নারীর শরীরকে করে তুলেছে ভোগ্য পণ্য যেখানে আদিবাসী মহিলা তাদের সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষমতাহীনতার জন্য অধিক শোষিত দুর্বল। শুধু তাই নয় তাদের ভাষা, যা মানুষের পরিচয় গড়ে তোলার অন্যতম উপাদান, আজ তা বিলুপ্ত প্রায়। এভাবেই পিতৃতান্ত্রিক সমাজের সাথে সমান্তরাল ভাবে উপনিবেশবাদ, সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ এবং বিশ্বায়ন তাদের অস্তিত্বকে এক প্রশ্নের মুখে ঠেলে দেয়। উপরের ছবিটি বোলপুরের শান্তিনিকেতনে, এক দল সাঁওতাল শিল্পী নিজেদের রীতিনীতি প্রচলিত সাংস্কৃতিক অঙ্গন বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টায়।

"আমি চাই এমন দেশ যেখানে ধর্ম নয়, মানুষ হবে রাষ্ট্র ব্যবস্থার মাপকাঠি " - উৎপল দত্ত। তাঁর অন্যতম সারা জাগানো নাটক গুলোর মধ্যে এক "জনতার অফিম" বর্তমান সময়ে রাষ্ট্র নামক নিরপেক্ষ ব্যবস্থায় যখন কোনো এক বিশেষ ধর্মের প্রভাব লেখনীয় তখন নাটক তথা এই উক্তির প্রাসঙ্গিকতা আজও বর্তমান নিঃসন্দেহে!

পাশ্চাত্যের দার্শনিক বার্ক একদা বলেছিলেন "মানুষ্যজাতি স্বভাবতই ধর্মীয় প্রাণী" কিন্তু বর্তমান সময়ে রাজনৈতিক পরিস্থিতি মনে প্রশ্ন জাগায়, মানুষ স্বভাবতই ধর্মীয় প্রাণী নাকি তাকে ধর্মীয় করে তোলা হয়? দক্ষিণ এশিয়ার বহু দেশে যখন বেকারত্ব তুঙ্গে, প্রতি জন পিছু আয়ের প্রবল ঘাটতি, খাদ্য, বস্ত্র বাসস্থানের অভাব তখন মানুষকে একপ্রকার কাল্পনিক ধর্মীয় পরিচয়ের সঙ্কট দ্বারা নেশাছন্ন করে রেখেছে বাংলাদেশ, আফগানিস্তানের উগ্র মৌলবাদী শক্তি এবং ভারতের উগ্র হিন্দুত্ববাদী শক্তি। তৈরি করা হয়েছে এক ধর্মীয় পরিচয়, যার বিরোধিতা রাষ্ট্র বিরোধিতার সমান হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাষ্ট্র ধর্মের ঘনিষ্ঠতা, মনুষ্যত্বের বিপর্যয় ডেকে আনছে নিঃসন্দেহে।

"ধর্ম হলো অফিম"- মার্ক্সের এই বিখ্যাত উক্তি যেনো আজও সমাজে খাটে। আধুনিকতা বিজ্ঞানের যুগে ধর্মের নেশা ক্রমাগত তৈরি করছে ভেদাভেদ, মানুষকে তৈরি করছে চিন্তাহীন পুতুলে। নেশা যেমন স্নায়ুকে করে তোলে দুর্বল এবং শিথিল ঠিক তেমনই "ধর্ম" সমাজকে করে তুলছে দুর্বল এবং শিথিল। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সমাজের কারাগার থেকে দক্ষিণ এশিয়ার বহু রাষ্ট্র মুক্তি পেলেও, ধর্ম নামক কারাগারে আজও বন্দি আমরা তাই, মানবতাবাদের অন্যতম পথিক কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের "ধর্মমোহ" কবিতার লাইন গুলি যেনো আজও প্রশ্ন করে এবং আহবান জানায় নতুন প্রভাতের,

"ধর্মকারের প্রাচীরে বজ্র হানো, অভাগা দেশে জ্ঞানের আলোক আনো।"

"It is important to realize that border not only joins what is different but also divides what is similar" - William Van Schandel (Bengal Borderland)

গ্রাম বাংলায় এখনও একটু খুঁজলে দেখতে পাওয়া যায় দুটি বাড়ির মাঝে লম্বা সারি সারি গাছ সীমানার কাজ করছে, প্রাকৃতিক সীমানাই বটে! বৃহত্তর স্কেলে চোখ রাখলে দেখা যাবে, প্রাকৃতিক সীমানার পরিবর্তে মনুষ্য সৃষ্টি সীমানার চাহিদা বেশি যা সাক্ষী কত ক্ষত-বিক্ষোত ইতিহাসের। ভারত- বাংলাদেশ সীমানা যেনো তেমনই এক উদাহরণ। নদীর জল, চোর, গ্রামের মন্দির, জঙ্গল যা একান্তই নিজের বলে জানতো মানুষ তা এক রাজনৈতিক ভূমিকম্পের ধাক্কায় হঠাৎ আরেক দেশের হয়ে যায়। শুধু তাই নয় নাগরিকত্বের দায়িত্ব যেনো ঝুলির বোঝা বাড়িয়ে তোলে। ভারত- বাংলাদেশ সীমানা সাক্ষী আছে বহু যুদ্ধ বিমানের। দুই রাষ্ট্র রাজনীতির সংঘাতে সাধারণ মানুষগুলোর ভিটে মাটি হয়ে উঠেছে রনক্ষেত্রে, হারিয়েছে তাদের পরিচয়, ইতিহাস অস্তিত্ব। কাঁটাতারের সীমানা ভেদ করে তাদের মন যেনো সেই 'আমার দেশের' আশায় আজও।

"ঠিক যেখানে দিনের শুরু, অন্ধ কালো রাত্রি শেষ

মন যতদুর চাইছে যেতে ঠিক ততদূর আমার দেশ।

এই কাঁটাতার, জঙ্গী বিমান, এই পতাকা রাষ্ট্র নয়-

দেশ মানে, বুক আকাশ জোড়া ইচ্ছে হাজার সূর্যোদয়"